কেউ যদি কোনো সুনির্দিষ্ট অপরাধ করে থাকে, তার জন্য আইন আছে, আদালত আছে। রাষ্ট্রের ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধিসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক আইনানুযায়ী তার বিচার হবে। আপনি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া মানে আদালত অবমাননা করা এবং আইনি কাঠামোর দিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল।
আদালতের কার্যবিধি অনুসারে আপনি একজন অভিযুক্ত ব্যক্তিকে তখনই অপরাধী বলতে পারবেন, যখন আদালত রায়ের মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী শনাক্ত করবেন এবং ঘোষণা করবেন। তার আগে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আপনি শুধুই ‘নিষ্পাপ অভিযুক্ত’ হিসেবে অভিহিত করতে পারেন।
একটি দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও রক্তিম রাজপথের কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দেওয়ার মধ্য দিয়ে যে মুক্তির দিশা আমরা দেখেছি গত ৫ আগস্ট, তা হেলায় হারালে চলবে না। এমন সুযোগ জাতীয় জীবনে পাওয়ার জন্য যুগ যুগ অপেক্ষা করতে হয়। এই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফলে যে অপেক্ষার প্রহর ভাঙল, এই প্রহরকেই কাজে লাগাতে হবে–সর্বোতভাবে যৌথ প্রচেষ্টায়।
যারা এমন সোনালি সময়কে নস্যাৎ করার জন্য মব ট্রায়ালের এন্তেজাম করছে, তাদের সচেতনতার সঙ্গে প্রতিরোধ করতে হবে। আমরা আমাদের দেশে কোনো হিংস্রতাকে স্থান দিতে প্রস্তুত নই। একটি উদার মানবিক বাংলাদেশ আমাদের আকাঙ্ক্ষা। এই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে যারা কাজ করতে প্রস্তুত, শুধু তারাই বিরাজ করবে এবং বাকিদের কীভাবে রিকনসিলিয়েশন করা যায়, সেদিকে গুরুত্বের সঙ্গে নজর দিতে হবে।
আপনাদের ভুলে গেলে চলবে না, রাষ্ট্র সবার, আপনার একার না। এই রাষ্ট্রে আপনার মতের মানুষ যেমন থাকবে, আপনার বিরোধীরাও বসবাস করবে। সবাই রাষ্ট্রের নাগরিক। রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রের আইনের সম্মুখে দণ্ডায়মান সবাই ষোলোআনার অধিকারী। কেউ বারো আনা কিংবা তার চেয়ে কম কিংবা বেশি কিছু পাওয়ার এখতিয়ার রাখেন না।
এমন অস্বাভাবিক সময়ে লেখাটি লিখতে হচ্ছে, যখন রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন কিংবা সংস্কারের কাজ চলমান। তবু নাগরিক হিসেবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে বাতিলের আগে যা কিছু অবশিষ্ট থাকে, তা পরম মান্য। আপনি যদি নিজেকে তার ঊর্ধ্বে মনে করেন, তবে বোঝা যাবে আইনের শাসনের প্রতি আপনি অঙ্গীকারবদ্ধ নন।
সংবিধান অনুসারে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ তার মানে হলো, যিনি বা যারাই এই রাষ্ট্রের নাগরিক হবেন, তারাই বিদ্যমান আইনের দৃষ্টিতে সমান হিসেবে বিবেচিত হবেন এবং আইন তাদের সমভাবে আশ্রয় ও নিরাপত্তা প্রদান করবে। ধর্ম, বর্ণ, গোত্র কিংবা জাত-পাত নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিক সমভাবে স্বীকৃত হবেন। কেউ কারও ধর্মীয়, গোত্রীয়, বর্ণীয় এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের দরুন ভিন্নভাবে স্বীকৃত হবেন না। সমান মানে সমান।
এই একই সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ‘আমরা যাহাতে স্বাধীন সত্তায় সমৃদ্ধি লাভ করিতে পারি এবং মানবজাতির প্রগতিশীল আশা-আকাঙ্ক্ষার সহিত সংগতি রক্ষা করিয়া আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার ক্ষেত্রে পূর্ণ ভূমিকা পালন করিতে পারি, সেই জন্য বাংলাদেশের জনগণের অভিপ্রায়ের অভিব্যক্তিস্বরূপ এই সংবিধানের প্রাধান্য অক্ষুণ্ন রাখা এবং ইহার রক্ষণ, সমর্থন ও নিরাপত্তা বিধান আমাদের পবিত্র কর্তব্য।’ সুতরাং সংবিধানানুযায়ী আপনি যে কেবল মৌলিক অধিকারের সুবিধা ভোগ করবেন তা নয়; আপনার কিছু পবিত্র দায়িত্বও বর্ণিত হয়েছে এই সংবিধানে। সুনাগরিক হিসেবে আপনি তা মানতে সাংবিধানিক আইনানুযায়ী স্বীকৃত। এখন আপনি যদি তা না মানেন, তবে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে আপনার কর্মকাণ্ড।
বলে রাখা ভালো, আইন দিয়ে ধরে-বেঁধে নীতিগত জায়গা পরিবর্তন সম্ভব নয় সবসময়। চর্চা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসের নাম প্রথা। ইউরোপ, আমেরিকায় লিখিত আইনের চেয়ে কাস্টমারি ল কিংবা প্রথাগত আইনের তাৎপর্য নজরে পড়ে সবচেয়ে বেশি। সে জন্য আইনের প্রতি নাগরিকের মান্যতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই মান্যতা কীভাবে ডেভেলপ করা যাবে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের। সে জন্যই আইনি কাঠামো পরিবর্তনের পাশাপাশি মনস্তাত্ত্বিক পরিকাঠামোর পরিবর্তন কিংবা পরিবর্ধন ফরজে পরিণত হয়েছে রীতিমতো।
আমাদের মনে রাখতে হবে, আমূল পরিবর্তন মানে অবকাঠামো কিংবা পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন কেবল নয়, ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক জায়গা এবং সামষ্টিক ফ্যাসিজমের পাশাপাশি ব্যক্তিগত ফ্যাসিজমেরও মূলোৎপাটন করতে হবে। পতিত স্বৈরশাসকের স্থান অন্যজন এসে দখল করতেও কার্পণ্য করবে না, যদি না এসব আইনবহির্ভূত কার্যকলাপ বন্ধ হয়, মব ট্রায়াল বন্ধ হয় এবং পরিশেষে একদল মানবিক দায়িত্বশীল শাসকের আবির্ভাব এবং মানবিক, মর্যাদাবান ও দায়িত্বশীল নাগরিকের উত্থান ঘটে। এবং তার মাধ্যমেই আমরা পেতে পারি একটি উদার মানবিক মর্যাদাবীরোচিত রাষ্ট্র–বাংলাদেশ, যার নবজাগরণের ছোঁয়া ছড়াতে পারি পৃথিবীময়।